শ্বশুরকে হত্যার দায়ে জামাই এবং তার ভাইকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন আদালত। মঙ্গলবার (১৩ মে ) বিকেল পৌঁণে ৪টার দিকে খুলনার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক সুমি আহমেদ এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় জামাই ও তার ভাই আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওই আদালতের বেঞ্চ সহকারী শুভেন্দু রায় চৌধুরী।
সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, দৌলতপুর থানা এলাকার আতিয়ার রহমানের বাড়ির বাসিন্দা মো. শেখ তুজামের ছেলে মো. শেখ রাশেদ এবং তার ছোট ভাই মো. শেখ রকিবুল ইসলাম।
হত্যাকান্ড সম্পর্কে এজাহার থেকে যা জানা যায়, ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬ টার দিকে মোবাইলে কথা বলতে-বলতে আ: রশিদ ঢালী বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। রাত ৮ টার দিকে মেয়ে তিন্নির ফোনে কল দিয়ে তার বাবা রশিদ বলেন, তিনি ফুলবাড়ি গেটে অবস্থান করছেন। তখন মেয়ে তিন্নি বাবাকে দ্রুত বাড়িতে আসার জন্য তাড়া দিতে থাকে। বাড়িতে বাবা ফিরে না আসায় সাড়ে ৮ টার দিকে পুনরায় বাবার ফোনে কল দিলে বন্ধ আছে বলে জানতে পারে তিন্নি। রাত ৯ টার দিকে বাবার ফোন থেকে কল আসলে বিপরীত থেকে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি জানায় ওই নম্বরটি তিনি রাস্তায় পেয়েছেন। তিন্নি তার অবস্থান জানতে চাইলে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ফোনটি বন্ধ করে দেয়। তখন মেয়ে জামাই রাশেদকে ফোন দিলে সে রশিদের বাড়িতে আসে এবং তারা সকলে মিলে রশিদের সন্ধানে বিভিন্নস্থানে খোঁজ করতে বের হয়। দু’দিন পর পরিবারের লোকজন জানতে পারে যে, আড়ংঘাটা থানার তেলীগাতি বাইপাস মহাসড়কের পাশে রিপন ফকিরের মাছের ঘেরের পাশে একটি লাশ পড়ে আছে। এমন সংবাদ পেয়ে ভুক্তভোগী পরিবার সেখানে গিয়ে আ: রশিদের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী ফারজানা বেগম অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে ২৪ অক্টোবর আড়ংঘাটা থানায় মামলা দায়ের করেন, যার নং ৪।
হত্যা মামলায় যেভাবে দু’ভাইয়ের সম্পৃক্তি :
রাশেদ বগুড়াতে পাখির ব্যবসা করত। বিয়ের দু’মাস পূর্ব থেকে তিন্নিদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল রাশেদের। ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর আ: রশিদের মেয়ে তিন্নির রাশেদের সাথে বিয়ে হয়। বিয়ের পর রাশেদ জানতে পারে তার বাবার কোন আয়-রোজগার নেই। তাদের সংসার চলে না। সে কারণে রাশেদ তিন্নির বাবাকে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে ইজিবাইক কিনে দেন। এরপরও প্রতিদিনের খরচ বাবদ টাকা দিত রাশেদ। তাছাড়া বিয়ের পর রাশেদ বুঝতে পারে যে স্ত্রীর সাথে অন্য পুরুষের সম্পর্ক রয়েছে। বিয়ের পঞ্চম দিনের মাথায় রাত দেড়টা ঘুম থেকে উঠে দেখে তার স্ত্রী তার পাশে নেই। পাশের ঘরে গিয়ে স্ত্রী, শাশুড়ি এবং শ্বশুর এক সাথে বসে নেশা করছে। পরে রাশেদ জানতে পারে তারা মাদকাসক্ত। পরে এ বিষয়টি নিয়ে শ্বশুরের সাথে আলোচনা করলে প্রতি উত্তরে তিনি জানান, যতদিন বেঁচে আছি ততোদিন এ নেশা চলবে। এরপর রাশেদ স্ত্রীকে নিয়ে বগুড়া চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ বিষয়টি শাশুড়িকে জানালে আর কিছুদিন অপেক্ষা করার কথা জানান তারা।
তাছাড়া শ্বশুরের কাছে পাওনা ২০ হাজার টাকা ফেরত চাইলে আজ না কাল বলে সময় ক্ষেপন করতে থাকে। ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর সন্ধ্যায় ছোট ভাই রকিবুলের সাথে দেখা করে রাশেদ। তখন তাকে কিছু টাকা দিলে ৩০ টাকা দিয়ে সে ফল কাটা ছুড়ি ক্রয় করে। মোটরসাইকেলে চড়ে দু’ভাই ফুলবাড়ি বাইপাস সড়কে যায়। ল্যাবরেটরী স্কুলের মোড়ে পৌঁছালে শ্বশুর আমাকে ডাক দিলে মোটরসাইকেল থামাই। পরে তিনি জানান, ফুলবাড়ি বাইপাসে যাবেন। বাইপাসে যাওয়ার পথে মোটরসাইকেল নষ্ট হয়েছে এমন ভান ধরে গাড়ি থামালে ছোট ভাই পেছন থেকে এসে শ্বশুরের গলায় চাকু ধরে। অন্ধকারে প্রথমে শ্বশুর ছুড়ি দেখতে না পেয়ে অতংকে সরে যেতে চাইলে তার গলায় পোচ লাগে। গলা চেপে রেখে তিনি রাস্তায় দৌড়াতে থাকে। তখন রাশেদ ও রকিবুল মোটরসাইকেল নিয়ে পিছে-পিছে যেতে থাকে। একপর্যায়ে রাস্তার মাইলপোষ্টে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান। তখন রাশেদ তার কাছে গিয়ে দেখে শ্বশুর মরনাপন্ন। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য কাছে থাকা মোটরসাইকেলের চাবি গলার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। পরবর্তীতে মৃত্যু নিশ্চিত করে লাশ রাস্তা থেকে ঠেলে নিচের দিকে ফেলে দেওয়া হয়। ছোটভাই রকিবুল ছুড়ি ফেলে দিয়ে বাড়িতে চলে আসে। পরে রাশেদ ফোন পেয়ে অন্যান্য সদস্যদের সাথে শ্বশুরকে খুজতে বের হয়। যা রাশেদ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আড়ংঘাটা থানার এসআই মো. রফিকুল ইসলাম তাদের দু’ভাইয়ের নামে আদালতে একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
খুলনা গেজেট/সাগর/এএজে